নিরাপদ খাদ্য নিরাপত্তায় ধানক্ষেতে
সমন্বিত মাছ উৎপাদন কৌশল
মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন
বাংলাদেশ ১,৪৪,০০০ বর্গ কিমি. আয়তনের ১৬৫.৫৮ মিলিয়ন (বিবিএস-২০২২) লোকের বসবাস, ফলে এটি বিশ্বের জনবহুল দেশসমূহের একটি। আমাদের একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। অর্থাৎ আবহমান কাল থেকেই মাছ এবং ভাত বাঙালির খাদ্য তালিকার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের দেশে প্রতি বছর ৩ মিলিয়ন লোক মোট জনসংখ্যার সাথে যুক্ত হচ্ছে, ফলে খাদ্যের চাহিদা বেড়েই চলছে। উদ্ভুত সমস্যা সমাধানে খাদ্যের জোগান, আয় এবং পুষ্টির চাহিদা পূরণে সমন্বিত ধানক্ষেতে মাছ চাষ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়/কৌশল। জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, অব্যাহত জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাহিদা পূরণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং পুষ্টির চাহিদা পূরণে সমন্বিত ধানক্ষেতে মাছ চাষের বিকল্প নেই।
ধানক্ষেতে মাছ চাষের সুবিধা : ধানক্ষেতে মাছ চাষ করলে অতিরিক্ত ফসল হিসেবে মাছ পাওয়া যায়। মাছের দেহের বর্জ্য ধানক্ষেতে সার হিসেবে কাজ করে ফলে মাটির উর্বরতা বাড়ায়। মাছ ধানক্ষেতের ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফেলে ফলে জমিতে কীটনাশক ছিটানের প্রয়োজন হয় না এবং খরচ কম হয়। ইঁদুরের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা পায়। যেহেতু কোন ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় না, তাই এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত ধান বিষমুক্ত এবং এর বাজারমূল্য বেশি। ধানক্ষেতে মাছ চাষ পরিবেশগতভাবে উপকারী কারণ এর ফলে ফসফরাস এবং নাইট্রোজেনের আধিক্য মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, পানিতে অক্সিজেনের প্রবাহ বাড়ায় এবৎ জলজ আগাছা নিয়ন্ত্রণ করে। ধানক্ষেতে মাছ চাষ করলে চাষির মুনাফা ৩ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় এবং ধানের উৎপাদন ১০-১২% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
ধানক্ষেতে মাছ চাষের বর্তমান প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০২২ এর তথ্য মতে আমাদের দেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৮.২৯ লাখ হেক্টর, সেচকৃত জমির পরিমাণ ৭৮.৭৯ লাখ হেক্টর এবং ২৬.৪৬ লাখ হেক্টর প্লাবনভূমি (উড়ঋ-২০২২) রয়েছে। ধানক্ষেতে মাছ চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও মোট কি পরিমাণ ধানের জমিতে মাছ চাষ হচ্ছে বা কি পরিমাণ ধানি জমি মাছ চাষের উপযোগী এবং কি পরিমাণ মাছ ধান ক্ষেত হতে উৎপাদিত হয় তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন মৎস্য সংকলনে ধানক্ষেতে মাছের উৎপাদনকে মৌসুমি জলাশয়ের সাথে একীভূত করে দেখানো হয়।
ধানক্ষেতে চাষযোগ্য মাছের প্রজাতি এবং ধানের জাত : ধানক্ষেতে চাষযোগ্য উল্লেখ্য মাছের প্রজাতি হলো গলদা, বাগদা, তেলাপিয়া, পার্সি, কমনকার্প, সিলভার কার্প, রুই, রাজপুটি, শিং, মাগুর ইত্যাদি। উচ্চফলনশীল ধানের জাত যা নুয়ে পড়ে না, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এমন উচ্চফলনশীল ধান যেমন : বোরো মৌসুমের জন্য বিআর-১, বিআর-২, বিআর-৩, বিআর-৭, বিআর-৮, বিআর-৯ বিআর-১২, বিআর-১৪, বিআর-১৮, ব্রি ধান-৩৫, ব্রি ধান৪৭ ও ব্রি ধান৫৫। আমন মৌসুমের জন্য বিআর-৪, বিআর-১০, বিআর-১১, বিআর-২২, বিআর-২৩, ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৪৪ ও ব্রি ধান৫৬। এছাড়া ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান৬১, বিনা-৮ এবং বিনা-১০ লবণাক্ত সহনশীল জাতের ধানের সাথে চিংড়ি চাষ করা যায়।
চাষ পদ্ধতি : ধানক্ষেতে মাছ চাষকে সাধারণত দুইভাগে ভাগ করা হয় : ধানের সাথে মাছ চাষ এবং ধানের পরে মাছ চাষ
ধানের সাথে মাছ চাষ : আমন মৌসুমে বর্ষাকালে জমিতে যখন ৪-৫ মাস পানি থাকে অথবা বোরো মৌসুমে সেচের পানির সুবিধা আছে এমন জমিতে একইসাথে ধান ও মাছ চাষ করা হয়।
ধানের পরে মাছ চাষ : আমন মৌসুমে বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানির কারনে ধান চাষ ব্যহত হয় তখন মাছ চাষ করা হয় অথবা বোরো মৌসুমে পানির অভাব থাকে সেক্ষেত্রে ধানের পরে মাছ চাষ করা হয়। আমাদের দেশে কুমিল্লা জেলায় এই পদ্ধতিতে মাছ করা হয় যা দাউদকান্দি মডেল নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
আমাদের দেশে দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে ধানের জমিতে লবণাক্ততার উপর ভিত্তি করে বাগদা এবং গলদা চিংড়ি চাষ করা হয়।
চাষ পদ্ধতি : বর্ষাকালে লবণাক্ততার পরিমাণ ‘০’ পিপিটি (পার্টস পার থাউজেন্ড, সালাইনোমিটার) হলে ধানের সাথে গলদা চিংড়ি চাষ করা হয়।
অপরদিকে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে লবণাক্ততা বাড়তে থাকে, তখন বাগদা চাষ করা হয়। দেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে ফেব্রুয়ারি-মার্চে ধানের জমিতে তেলাপিয়া এবং কমন কার্পের পোনা উৎপাদন করা হয়। প্রতি হেক্টর ধানের জমিতে ৩-৪ লাখ পোনা উৎপাদন করা হয়। কোন কোন জায়গায় ধানের সাথে শিং এবং মাগুর চাষ করা হয়। এক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ১০,০০০-১২০০০টি শিং মাগুরের পোনা অবমুক্ত করে হেক্টরপ্রতি ১৩০০-১৫০০ কেজি মাছ উৎপাদিত হয়।
এশিয়ার কয়েকটি দেশে ধানক্ষেতে মাছ চাষ কৌশল
চীন : এশিয়ার মধ্যে চীন ধানক্ষেতে মাছ চাষে অগ্রগামী। ধান রোপণের জন্য জোড়া সারি পদ্ধতি অনুসরণ করে, ধানের জমিতে পানির গভীরতা ৫-১০ সেমি., সারি থেকে সারির দূরত্ব সর্বনিম্ন ১৮ সেমি. থেকে সর্বোচ্চ ৩৬ সেমি., মজুদ ঘনত্ব ১৩১২৫টি/হে. এবং গড় উৎপাদন ২.৫ টন/হে.। চীনের কোন কোন প্রদেশে সমন্বিত ধান মাছের সাথে হাসও প্রতিপালন করা হয়।
ভিয়েতনাম : ধানের পরে ও ধানের সাথে দুই পদ্ধতিতে ভিয়েতনামে মাছ চাষ হয়। কমনকার্প, রুই, সিলভার কার্প, গলদা, বাগদা, তেলাপিয়া ইত্যাদি মাছ ধানক্ষেতে চাষ করা হয়। প্রতি বর্গমিটারে ২টি করে মাছ মজুদ করা হয়, দেহ ওজনের ২-৩ ভাগ খাদ্য প্রয়োগ করে হেক্টরপ্রতি ২.২ টন মাছ উৎপাদন রেকর্ড করা হয়েছে। অপর দিকে প্রতি বর্গমিটারে ১০-১৫টি পি এল মজুদ করে হেক্টরপ্রতি ৭০০ কেজি থেকে শুরু করে ৩.৫ টন পর্যন্ত চিংড়ি মাছ উৎপাদন রেকর্ড করা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়া : ধানক্ষেতে মাছ চাষে ইন্দোনেশিয়া উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রথম পর্যায়ে পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করে পরে ক্লাস্টার এপ্রোচ পদ্ধতি অনুসরণ করে মাছ চাষে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। বর্তমানে ইয়োগিকার্তা প্রদেশে সরকারের সহায়তায় ১ মিলিয়ন হে: জমিতে সমন্বিত ধানক্ষেতে মাছ চাষ করছে এবং এফ এ ও তাদের কারিগরি সহযোগিতা করছে। ধানী জমির চারপাশে ৪-৫ শতাংশ জায়গায় নালা তৈরি করে পলিথিনের শিট বিছিয়ে দেওয়া হয় ফলে পানি চুয়ে যায় না। ধান রোপণের জন্য জোড়া সারি পদ্ধতি অনুসরণ করে, ধানের জমিতে পানির গভীরতা ৫-১৫ সেমি. এবং নালায় পানির গভীরতা ৬৫-৬৯ সেমি. থাকে। প্রতি বর্গমিটারে ১.২টি করে লাল তেলাপিয়া মজুদ করা হয়। মোট দেহের ওজনের ২-৩ শতাংশ হারে ২৫% আমিষ সমৃদ্ধ পিলেট খাবার প্রতিদিন দুইবার করে দেওয়া হয়। হেক্টরপ্রতি সর্বোচ্চ ৪.৪ টন মাছ উৎপাদন রেকর্ড করা হয়েছে।
ধানক্ষেতে মাছ চাষে সমস্যা : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কারিগরি জ্ঞানের অভাব, বন্যা ও খরা, জলাবদ্ধতা, রোগবালাই, মাছ চুরি, সময়মতো মানসম্মত পোনা না পাওয়া, উচ্চশ্রমিক মূল্য, প্লট প্রস্তুতিতে অধিক খরচ, মাছের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু ইত্যাদি ধানক্ষেতে মাছ চাষে প্রধান বাধা। ধানক্ষেতে মাছ চাষে সমস্যাসমূহকে প্রধান তিনভাগে ভাগ করা যায় : মূলধনের অভাব; কারিগরি সমস্যা এবং সামাজিক সমস্যা।
এ ছাড়া গুণগত মানের পোনার অভাব, পোনার উচ্চমূল্য, মাছের খাদ্যের অধিক দাম, উৎপাদিত মাছের বাজারজাতকরণের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় চাষিরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে চাষিদের আগ্রহ কম লক্ষ্য করা যায়। এককথায় সমন্বিত ধানক্ষেতে মাছ চাষ মূল কৃষির অংশ হিসেবে এখনও বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা পায়নি।
বাংলাদেশে ধানক্ষেতে মাছ চাষের সম্ভাবনা : আবাদযোগ্য জমি সেচকৃত আবাদি জমি এবং প্লাবনভূমি জমিসমূহ সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রায় উৎপাদনশীল করার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত, আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আমিষের চাহিদা পূরণ তথা ২০৪১ এর প্রজেকশান নির্ধারণ করা হয়েছে তা বাস্তবায়নে ধানক্ষেতে মাছ চাষ হতে পারে একটি সহজ কৌশল। আমাদের দেশে যে পরিমাণ ধানী জমি রয়েছে তার ২.৮৩ মিলিয়ন জমি ধানক্ষেতে মাছ চাষের আওতায় আনা যায় তাহলে প্রতি বছরে ০.৭৩ মিলিয়ন টন অতিরিক্ত মাছ উৎপাদিত হবে (অযসবফ ধহফ এধৎহবঃঃ ২০১১). আর্থিক বিশ্লেষণে দেখা যায় সমন্বিত ধানক্ষেতে মাছ চাষ করলে চাষির মুনাফা ৬৫.৮% বৃদ্ধি পায় (ঝধরশরধ ধহফ উধং ২০০৮). ধানের একক চাষ অপেক্ষা সমন্বিত ধানক্ষেতে মাছ চাষ করলে চাষির লাভ ৩ গুণ বৃদ্ধি পায় (জধযসধহ বঃ ধষ. ২০১২). অধিক উৎপাদনশীলতা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, অব্যাহত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সহজ প্রযুক্তি, কম কার্বন নি:সরণ তথা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে সমন্বিত ধানক্ষেতে মাছ চাষ একটি একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনার নতুন কৌশল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
ধানক্ষেতে মাছ চাষ এর সুফল পেতে কার্যকর কৌশল গ্রহণ
সরকারি বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা; ডিজেল ভতুর্কির মতো ধানক্ষেতে মাছচাষিদের ভর্তুকি প্রদান করা; প্রশিক্ষণ, শিক্ষা এবং প্রদর্শনী খামার স্থাপন করে চাষিদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি; মাঠপর্যায়ে জনবল বৃদ্ধি করে সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার করা এবং চাষিদের প্রযুক্তি গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণ; প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন : মাছের খাদ্য ও গুণগত মানের পোনা নিশ্চিত করা এবং উৎপাদিত ধান ও মাছের বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করা যেন চাষি ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত না হয়; ইন্দোনেশিয়ার মতো ক্লাস্টার এপ্রোচ পদ্ধতি অনুসরণ করা; সেচ বা অন্য বিকল্প উপায়ে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ নিশ্চিতকরণ; সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করা এবং চাষিদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।
দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জমি খ--বিখ-করণের ফলে জমির আনুভূমিক সম্প্রসারণ দ্রুত গতিতে হ্রাস পাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সরকারের ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নের জন্য ধান ক্ষেতে মাছ হলো একটি সহজ প্রযুক্তি। সেচকৃত আবাদি জমির পরিমাণ ৭৮.৭৯ লাখ হেক্টর (বিবিএস-২০২২) এর মধ্যে ২০% জমি সমন্বিত ধান ক্ষেতে মাছ চাষের আওতায় আনা যায় এবং প্রতি হেক্টরে ১ মে. টন মাছ উৎপাদন করা যায় তাহলে বছরে প্রায় ১৬ লাখ মে. টন অতিরিক্ত মাছ উৎপাদিত হবে যা দেশের মোট ইলিশ উৎপাদনের প্রায় ৩ গুণ। তাই ধান ক্ষেতে মাছ চাষ প্রযুক্তি বিস্তারে অধিক কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
লেখক : সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার, মনোহরদী, নরসিংদী। মোবাইল : ০১৮৪৯-৫০৬৪৬৮, মেইল :ufozia25th@gmail.com